মালয়ালম চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহী কবির, যিনি নিজেও একসময় পুলিশে ছিলেন, তাঁর সিনেমায় বারবার পুলিশের ভেতরের জগৎটা তুলে ধরেন। তাঁর প্রতিটি কাজে ‘জোসেফ’, ‘নায়াত্তু’, ‘অফিসার অন ডিউটি’ থেকে শুরু করে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রন্থ’ সবখানেই পুলিশকে দেখা যায় এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এইবার, তাঁর পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘রন্থ’-এ তিনি কোনো সাধারণ পুলিশি তদন্তের গল্প নয়, বরং এক রাতের টহল ডিউটির মধ্য দিয়ে পুলিশের বাস্তব জীবনের এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন। এই সিনেমা এক জার্নি, যা আপনাকে গভীর রাতে শুরু হয়ে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে।
এক নজরে ‘রন্থ’:
এক নজরে ‘রন্থ’:
সিনেমা: ‘রন্থ’
ধরন: ক্রাইম থ্রিলার, ড্রামা
পরিচালনা: শাহী কবির
অভিনয়ে: দীলেশ পোথান, রোশন ম্যাথিউ, অরুণ চেরুকাবিল, রোশান আব্দুল রাহুফ
স্ট্রিমিং: জিওহটস্টার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২ মিনিট
গল্পের পটভূমি: দুই বিপরীত চরিত্রের এক যাত্রা
সিনেমার গল্পটি অভিজ্ঞ পুলিশ সদস্য ইওহানন (দীলেশ পোথান) এবং নবীন, আদর্শবাদী দিন্নাথকে (রোশন ম্যাথিউ) নিয়ে। তাদের এই জুটি দেখতে অনেকটা পশ্চিমা সিনেমার মতো মনে হলেও এর প্রতিটি পরতে মিশে আছে এই অঞ্চলের মাটির গন্ধ। ইওহানন পেশাগত নিষ্ঠুরতা আর অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত, যার কাছে সিস্টেমের ত্রুটিগুলো আর নতুন কিছু নয়। অন্যদিকে, দিন্নাথ এখনো আদর্শের পথে চলা এক নতুন অফিসার, যিনি এখনো সিস্টেমের পেছনের 'ভূত' সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন।
এক রাতের টহল ডিউটিতে তারা কেরালায় এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যান, যেখানে তারা মুখোমুখি হন জাত-প্রথা নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুর্ঘটনা, এমনকি কিছু অস্বাভাবিক ঘটনারও। এই পুরো রাতজুড়ে তাদের দুজনের মধ্যে বারবার দ্বন্দ্ব দেখা যায়, যা তাদের ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা তুলে ধরে। ইওহানন যেমন ছোটখাটো অনিয়মের মাধ্যমে সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছেন, তেমনি দিন্নাথ এখনো তাঁর আদর্শ ধরে রাখতে চান। যেমন, একটি ছোট দুর্ঘটনার পর ইওহানন এক পাদরির কাছ থেকে টাকা নেন, কিন্তু স্পষ্ট করে দেন এটি ঘুষ নয়, বরং পুলিশের গাড়ির মেরামতের খরচ। এই ছোট ছোট দৃশ্যগুলোই পুলিশের বাস্তব জীবনের কঠিন দিকগুলোকে তুলে ধরে।
ভয়াবহ ক্লাইম্যাক্স এবং নির্মম পরিণতি:
রাতের টহল যতই গভীর হয়, সিনেমার মেজাজ ততই পাল্টে যায়। একসময় ‘বাডি কপ’ থ্রিলারের মতো মনে হলেও, শেষ ১৫ মিনিট আপনাকে এতটাই নাড়িয়ে দেবে যে মনে হবে যেন এটি কোনো সিনেমা নয়, বরং বাস্তব জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। তারা দুজনই তখনো জানেন না, এক দলিত যুবকের মৃত্যু তাদের জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দেবে।
এই মৃত্যুর তদন্তে তারা জড়িয়ে পড়েন এক ভয়ংকর খেলায়। তারা নিজেদের রক্ষক হিসেবে নয়, বরং সিস্টেমের শিকার হিসেবে আবির্ভূত হন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের বলির পাঁঠা বানিয়ে বাহবা কুড়াতে চান। যখন তাদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়, তখন তাদের সম্পর্কের আসল পরীক্ষা হয়। অভিজ্ঞ ইওহানন দৃঢ়তার সঙ্গে এই খেলাকে চ্যালেঞ্জ জানান, কিন্তু তরুণ দিন্নাথ নিজের পরিবার ও অপরাধবোধে ভেঙে পড়েন এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জানতে পারেন, দুজনকেই আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। তরুণ দিন্নাথ তখন বিশ্বাসভঙ্গকারী এবং এক ক্লান্ত ট্র্যাজেডির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন।
অভিনয় ও বার্তা: মানবিকতার এক করুণ গল্প:
দীলেশ পোথান ও রোশন ম্যাথিউ তাদের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। রোশনের দিন্নাথ চরিত্রটি এতটাই বাস্তব যে দর্শক তার জন্য সহানুভূতি অনুভব করবে। অন্যদিকে, দীলেশ পোথানের ইওহানন চরিত্রটি এক হতাশ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিচ্ছবি যিনি একসময় আদর্শবাদী ছিলেন। তিনি তার মৃত সন্তানের শোক বহন করেন এবং হয়তো দিন্নাথের মধ্যেই নিজের পুরোনো স্বপ্নকে খুঁজে পান।
‘রন্থ’ শাহী কবিরের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সিনেমা হয়তো নয়, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে তাঁর সবচেয়ে মানবিক কাজগুলোর একটি। এখানে রোমাঞ্চের চেয়ে বেশি আছে জীবনবোধ, আদর্শ এবং বাস্তবতার কঠিন আঘাত। সিনেমাটি শেষ হলে আপনার মনে হতে পারে, পুলিশের পোশাকের নিচে থাকা মানুষটি হয়তো রাতের টহল শুরু হওয়ার সময়ই হারিয়ে যায়, যখন তার চোখের সামনে তার দীর্ঘদিনের লালিত আদর্শগুলো ভেঙে পড়ে।
‘রন্থ’ শাহী কবিরের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সিনেমা হয়তো নয়, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে তাঁর সবচেয়ে মানবিক কাজগুলোর একটি। এখানে রোমাঞ্চের চেয়ে বেশি আছে জীবনবোধ, আদর্শ এবং বাস্তবতার কঠিন আঘাত। সিনেমাটি শেষ হলে আপনার মনে হতে পারে, পুলিশের পোশাকের নিচে থাকা মানুষটি হয়তো রাতের টহল শুরু হওয়ার সময়ই হারিয়ে যায়, যখন তার চোখের সামনে তার দীর্ঘদিনের লালিত আদর্শগুলো ভেঙে পড়ে।