ভারতী সিংয়ের জীবনের শুরুটা ছিল কষ্ট, সংগ্রাম আর অদম্য সাহসের এক বাস্তব উদাহরণ। মাত্র দুই বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। বাবা চলে যাওয়ার পর পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর মায়ের কাঁধে। মা কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে-রান্নাবান্না, ঝাড়ু দেওয়া, এমনকি টয়লেট পরিষ্কারের মতো কঠিন ও অবহেলিত কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। ছোট্ট ভারতী তখন মায়ের কাজের শেষে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন—সেই সময়ের স্মৃতি আজও তাঁর চোখে জল নিয়ে আসে। মায়ের কাজ শেষে পাওয়া বাসি খাবার দিয়েই চলত তাদের সংসার। ভালো খাবার তো দূরে থাক, অনেক দিন শুধু লবণ আর রুটি খেয়েই থাকতে হতো তাদের। উৎসবের দিনগুলোও ছিল কষ্টের, যেখানে অন্যরা নতুন জামা, খাবার আর আনন্দে মেতে উঠত, ভারতী শুধু চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন।

অভাব এতটাই ছিল যে, ভারতীর বড় ভাই ও বোন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কম্বলের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। সেখানে তারা এত ভারী কম্বল তৈরি করত, যেগুলোর ওজন নিজেরাও বহন করতে পারত না। এসব অভিজ্ঞতা তাঁকে মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তোলে। তাঁর নিজের ভাষায়, সেই সময়টাকে মনে হয় অন্ধকার, কিন্তু সেটাই তাঁকে আজকের ভারতী সিং বানিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই ভারতী ছিলেন মজার স্বভাবের এবং তিনি নিজেই বলেছেন, কমেডি যেন তাঁর রক্তে ছিল। কলেজজীবনে থিয়েটার ও নানা কমেডি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন তিনি। একদিন তাঁর প্রতিভা নজরে পড়ে একটি বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের। এরপর অডিশনের ডাক আসে ‘কমেডি সার্কাস’ নামের জনপ্রিয় শোতে। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত। অমৃতসর থেকে জীবনের প্রথম বিমান যাত্রায় মায়ের সঙ্গে পা রাখেন মুম্বাইয়ের পথে। সেখানে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ‘লালি’ নামের একটি চরিত্রে অভিনয় করে ভারতজুড়ে আলোচনায় চলে আসেন।

সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর পেশাদার কমেডিয়ান জীবন। তিনি একে একে কাজ করেছেন বহু জনপ্রিয় টিভি শোতে—‘কমেডি নাইটস’, ‘দ্য কপিল শর্মা শো’, ‘খতরো কে খিলাড়ি’ সহ আরও অনেক রিয়্যালিটি ও কমেডি অনুষ্ঠানে। তাঁর স্বতন্ত্র কৌতুক ধারা, টাইমিং, এবং নারী হয়েও পুরুষ-প্রধান কমেডি ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রমাণ করা তাঁকে এনে দিয়েছে আলাদা সম্মান।

শুধু অভিনয়েই নয়, উপস্থাপনাতেও সমানভাবে সফল তিনি। ‘ঝলক দিখলা যা ৫’-তে প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়ে দর্শকদের ভালোবাসা অর্জন করার পর তিনি উপস্থাপক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেন। ‘ডান্স দিওয়ানে’, ‘সা রে গা মা পা লি’ল চ্যাম্পস’, ‘হুনরবাজ’ থেকে শুরু করে ‘লাফটার শেফস’ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হিট রিয়্যালিটি শোর সঞ্চালক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। জনপ্রিয়তা ও পরিশ্রমের ফল হিসেবে এখন তিনি প্রতিটি পর্ব উপস্থাপনার জন্য ১০-১২ লাখ রুপি পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন।

ভারতীর রয়েছে একটি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ‘ভারতী টিভি’, যেখানে তিনি ব্যক্তিজীবনের নানা মুহূর্ত, মজার কনটেন্ট এবং পারিবারিক গল্প শেয়ার করেন। এছাড়াও স্বামী হর্ষ লিম্বাচিয়ার সঙ্গে তিনি পরিচালনা করেন আরেকটি চ্যানেল ‘লাইফ অব লিম্বাচিয়াস’। তাঁর ইনস্টাগ্রামে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ, যা তাঁর জনপ্রিয়তার স্পষ্ট প্রমাণ।

বর্তমানে টাইমস অব ইন্ডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, ভারতী সিংয়ের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ কোটি টাকা)। তাঁর মালিকানায় রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি, আর মুম্বাইয়ের মতো শহরে একটি দামি ফ্ল্যাট যার মূল্য প্রায় ৬ কোটি রুপি। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা এই নারী আজ বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী কমেডি শিল্পী।

ভারতী সিংয়ের জীবনের এই সংগ্রাম, উত্থান ও সাফল্যের গল্প অনেক তরুণ-তরুণীর অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, জন্ম কিংবা দারিদ্র্য আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না-দৃঢ় মনোবল, কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই পারে জীবন বদলে দিতে। এক সময়ের বাসি খাবারে বেঁচে থাকা মেয়েটিই আজ কোটি কোটি মানুষের হাসির কারণ এবং এক জীবন্ত প্রমাণ-“স্বপ্ন দেখো, আর হাল ছাড়ো না।”