বিখ্যাত ভারতীয় নির্মাতা বিমল রায়ের ক্ল্যাসিক ছবি 'দো বিঘা জমিন' (১৯৫৩) এবার নতুন করে ফিরে এসেছে। সম্প্রতি ফোর-কে সংস্করণে রূপান্তরিত এই সিনেমাটির প্রিমিয়ার হয়ে গেল ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ক্ল্যাসিকস বিভাগে। ১৯০৯ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই পরিচালকের জীবন ও তার শ্রেষ্ঠ ছবির পেছনের গল্প আজও অনেককে মুগ্ধ করে।

'দো বিঘা জমিন'-এর জন্ম

১৯৫০-এর দশকের শুরুতে সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি তার জানালার বাইরে কিছু রিকশাচালককে দেখেন, যারা নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প বলত। তাদের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি 'রিকশাওয়ালা' নামে একটি গল্প লেখেন। হৃষীকেশ মুখার্জীর মাধ্যমে সেই গল্পটি পৌঁছায় বিমল রায়ের কাছে। ইতালিয়ান নিওরিয়েলিস্ট ছবি 'বাইসাইকেল থিভস' দেখে অনুপ্রাণিত বিমল রায় তখন একটি বাস্তবধর্মী ছবি নির্মাণের কথা ভাবছিলেন। সলিলের গল্পটি তার খুব পছন্দ হয় এবং এভাবেই জন্ম নেয় 'দো বিঘা জমিন'-এর।

বলরাজ সাহনির রূপান্তর

শিক্ষিত ও শহুরে অভিনেতা বলরাজ সাহনিকে একজন গেঁয়ো চাষির চরিত্রে অভিনয় করানোটা ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। পরিচালক বিমল রায় প্রথমে তাকে দেখে হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু বলরাজ হাল ছাড়েননি। চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে তিনি বম্বের জোগেশ্বরীর খাটাল এলাকায় গিয়ে মানুষের চালচলন পর্যবেক্ষণ করেন। এমনকি কলকাতায় গিয়ে তিনি নিজে রিকশা চালানো শেখেন, যাতে একজন রিকশাচালকের কষ্ট তিনি অনুভব করতে পারেন। তার এই পরিশ্রমের ফল ছিল অসাধারণ; তিনি এতটাই নিখুঁতভাবে শম্ভু মাহাতো চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন যে, ইউনিটের সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

ছবির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা

'দো বিঘা জমিন' শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি সামাজিক ইতিহাসের একটি প্রতিচ্ছবি। ছবিতে দেখানো হয় কীভাবে একজন কৃষক তার সামান্য জমি বাঁচাতে শহরের নির্মম পরিবেশে রিকশা চালাতে বাধ্য হন। ভারতের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক শিবেন্দ্র সিং ধুঙ্গরপুর বলেন, 'বিমল রায় এই ছবিটি তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'র দুই বছর আগে। তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তববাদী অভিনয় ধারা যুগের পর যুগ টিকে আছে।'

ছবিটি পুনরুদ্ধার করা সহজ ছিল না। মূল ক্যামেরা নেগেটিভ অসম্পূর্ণ ছিল এবং সাউন্ডের মানও খারাপ ছিল। দীর্ঘ তিন বছরের প্রচেষ্টায় এটি ফোর-কে ফরম্যাটে রূপান্তরিত হয়েছে, যা এখন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হবে।

ঢাকা থেকে মুম্বাই: বিমল রায়ের জীবন

বিমল রায় ১৯০৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার বাবার মৃত্যুর পর তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এই কষ্ট তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি। ক্যামেরা নিয়ে তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল এবং এই আগ্রহই তাকে মুম্বাইয়ের বম্বে টকিজ-এ নিয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে নিজের প্রযোজনা সংস্থা খুলে তিনি 'দো বিঘা জমিন' নির্মাণ করেন, যা পরের বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে তার মৃত্যু হয়।