ঢালিউড
5 days ago
'লাঠিয়াল':প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া সিনেমা
ভাইব নিউজ
নারায়ণ ঘোষ মিতার কালজয়ী সিনেমা 'লাঠিয়াল' (১৯৭৫) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক মাইলফলক। এটি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমায় দুই ভাই কাদের (আনোয়ার হোসেন) এবং দুখু (ফারুক)-এর মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমাটির শক্তিশালী গল্প, চরিত্র এবং গান বিশেষভাবে প্রশংসিত। বিশেষ করে, এই সিনেমার মাধ্যমেই ফারুক 'মিয়া ভাই' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তির ৫০ বছর পরেও, 'লাঠিয়াল' তার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে।
'লাঠিয়াল': ৫০ বছর পরও প্রাসঙ্গিক এক কালজয়ী সিনেমা
১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল নারায়ণ ঘোষ মিতার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘লাঠিয়াল’। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই সিনেমাটি কেবল পুরস্কার আর দর্শক প্রশংসাই অর্জন করেনি, এটি দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবেও বিবেচিত হয়। সামাজিক বৈষম্য, গ্রামীণ জীবন আর সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামের এক অনবদ্য চিত্রায়ণ এটি। মুক্তির ৫০ বছর পেরিয়েও সিনেমাটি আজকের প্রেক্ষাপটে সমান প্রাসঙ্গিক।
‘বাঁশ দিয়ে বাঁশি হয়, আবার লাঠিও হয়’— সিনেমার শুরুর এই সংলাপই যেন এর মূল বার্তা। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, পারিবারিক টানাপোড়েন এবং মোড়লের অত্যাচারের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সাধারণ মানুষ কীভাবে রুখে দাঁড়ায়, সেটাই ঐতিহাসিক ক্লাইম্যাক্সের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
সিনেমাটির গল্প ও চরিত্র:
‘লাঠিয়াল’-এর গল্প দুই ভাই কাদের (আনোয়ার হোসেন) ও দুখু মিয়াকে (ফারুক) ঘিরে আবর্তিত। কাদের গ্রামের মোড়লের ডান হাত এবং লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান। অন্যদিকে, ছোট ভাই দুখু একজন 'আটিস্ট', যে যাত্রা বা পালা গেয়ে বেড়ায়। দুখুর প্রেমিকা বানু (ববিতা) গ্রামের এক স্বাধীনচেতা মেয়ে।
ঘটনার মোড় ঘোরে যখন শহরের মাতবরের ছেলে মকবুল (এ টি এম শামসুজ্জামান) বানুকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে। দুখু তাকে প্রতিরোধ করলে মোড়ল সেই ঘটনাকে উল্টোভাবে সাজিয়ে কাদেরকে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। ফলে ভাইয়ের 'দোষে' কাদেরকে 'নুন খেয়ে বেইমান' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এরপরই দুখু বাড়ি ছেড়ে গানের দলে যোগ দেয়।
সিনেমাটির ক্লাইম্যাক্স আসে যখন নদীতে জেগে ওঠা নতুন চর দখল করতে চায় মোড়ল। কাদের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে চর দখলে আসে, কিন্তু সেখানে প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ। তাদের নেতৃত্বে থাকে দুখু। ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুখুর সেই সংলাপ: ‘লাঠিয়ালের রক্ত আমার শরীরেও আছে’— যা সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর একটি।
‘লাঠিয়াল’ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সিনেমাটি কয়েকটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
পারিবারিক গল্পের অনবদ্য বুনন: পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা পারিবারিক গল্প, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের আবেগ পর্দায় তুলে ধরতে দারুণ দক্ষ ছিলেন। এই সিনেমায় কাদের ও দুখুর সম্পর্ক, দেবর-ভাবির খুনসুটি এবং পরবর্তী পারিবারিক টানাপোড়েন খুবই আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয়েছে।
মিউজিক্যাল সিনেমা: গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় ও সত্য সাহার সুরে সিনেমার সাতটি গানই দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানের মাধ্যমে গল্পের গতি ও গ্রামীণ আবহ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রূপক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমানের মতে, এই সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির সঙ্গে মেলানো যায়। গ্রামের মোড়ল এখানে রূপক অর্থে পাকিস্তান, মোড়লের সহযোগী কাদের দেশের কিছু মানুষের প্রতিভূ এবং দুখু সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। চর দখল মানে নিজের অধিকার হারানো। এই বিশ্লেষণ সিনেমাটিকে আরও গভীরতা দেয়।
ফারুক: গ্রামীণ চরিত্রের অনবদ্য রূপকার:
দুখু চরিত্রে ফারুকের অভিনয় ছিল অবিশ্বাস্য। তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গি, হাঁটাচলা, খাওয়ার পর ফতুয়া দিয়ে মুখ মোছার মতো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো চরিত্রটিকে বাস্তবসম্মত করে তোলে। প্রথমে ঘর-সংসারবিমুখ এক 'আটিস্ট' হিসেবে থাকলেও, শেষে প্রতিবাদী এক মানুষে রূপান্তরিত হয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেন। তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপ: ‘শরম করে না জমিতে পা রেখে পা উঠাইয়া নিতে’— আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। এই সিনেমার পর থেকে ফারুক 'মিয়া ভাই' হিসেবে পরিচিতি পান, যা তাঁর গ্রামীণ চরিত্রে সাবলীল অভিনয়ের স্বীকৃতি।
ববিতার চোখে 'কষ্টের পুরস্কার':
সিনেমার প্রধান অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ববিতা এখনো জীবিত আছেন। তিনি এই সিনেমাটিকে তাঁর অভিনয় জীবনের 'কষ্টের পুরস্কার' হিসেবে বর্ণনা করেন। বানু চরিত্রে অভিনয় করা এই অভিনেত্রী জানান, সিনেমার আউটডোর শুটিং ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। নদী-নালা পেরিয়ে দুর্গম চরে পৌঁছাতে হতো এবং প্রচণ্ড গরমের কারণে শুটিং করা ছিল কঠিন।
তবে তিনি বলেন, ‘মুক্তির পর প্রশংসা আর পুরস্কার সব ভুলিয়ে দেয়। কষ্টের পুরস্কার পেয়েছিলাম।’ তিনি পরিচালক মিতার গল্পের প্রশংসা করে আরও বলেন যে, চিত্রনাট্য পড়ে বানু চরিত্রটি তাঁর এতটাই ভালো লেগেছিল যে তিনি কাজ করতে রাজি হয়ে যান।
প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: পাঁচটি শাখায় বিজয়
১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, যা ১৯৭৫ সালের সিনেমাগুলোর জন্য দেওয়া হয়েছিল। মোট ১২টি শাখার মধ্যে ‘লাঠিয়াল’ একাই পাঁচটি পুরস্কার জিতে নেয়। এটি প্রথম সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়, এবং নারায়ণ ঘোষ মিতা হন সেরা পরিচালক। সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান আনোয়ার হোসেন (কাদের লাঠিয়াল চরিত্রে)। এছাড়া, ফারুক ও রোজী সামাদ যথাক্রমে সেরা পার্শ্ব-অভিনেতা ও সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী নির্বাচিত হন।
মুক্তির ৫০ বছর পেরিয়েও ‘লাঠিয়াল’ তার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে। বৈষম্য, শোষণ এবং সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের গল্প হিসেবে এই সিনেমাটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি অমূল্য সম্পদ।