আজ ১১ ডিসেম্বর, সেতারসম্রাট পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণদিবস। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে কেবল একটি ধারায় সীমাবদ্ধ না রেখে, সময়, ভূগোল ও সংস্কৃতির সীমারেখা পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতধারার মধ্যে সেতুবন্ধ ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ। অথচ এই মহীরুহ শিল্পীও তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণিল জীবনে অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, নীরব প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক বাস্তবতার মোকাবিলা করেছেন, যা তাঁর শিল্পসত্তাকে আরও মানবিক করে তুলেছে। নড়াইল জেলায় পৈতৃক নিবাস হলেও রবিশঙ্কর জন্ম নেন ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে, যেখানে গঙ্গার তীরঘেঁষা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবহ তাঁর মননে প্রাথমিক প্রভাব ফেলে।

রবিশঙ্করের শিল্পীজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকটি আসে তাঁর অগ্রজ, পথিকৃৎ নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের হাত ধরে। দাদার নৃত্যদলের সদস্য হিসেবে শৈশবেই তিনি ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ পান এবং সেখানে নৃত্য, সরোদ ও সংগীতের সমন্বিত চর্চা তাঁর শিল্পীসত্তার ভিত্তি গড়ে তোলে। প্যারিসে ইউরোপ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কিংবদন্তি সংগীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র, যাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণে তিনি মধ্যপ্রদেশের মাইহার শহরে যান। মাইহারে কাটানো সময়টি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন, যেখানে দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্ন রেওয়াজ ও মানসিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি একজন পরিপূর্ণ সেতারবাদক হিসেবে গড়ে ওঠেন। এখানেই তিনি ঘনিষ্ঠ হন আলাউদ্দিন খাঁ-র পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-র সঙ্গে।

১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের আন্তর্জাতিক সংগীতযাত্রা। তিনি নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করে রাগ, তাল ও রাগিণীর জগৎকে পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরেন। তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রধান দূত। পাশ্চাত্য সংগীতজগতের সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে তুলে জ্যাজ শিল্পী, ধ্রুপদি সুরকার ও জনপ্রিয় ব্যান্ডের সঙ্গে তাঁর যৌথ কাজ সংগীতের ভাষাকে নতুন মাত্রা দেয়। ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে 'ওয়ার্ল্ড মিউজিক'-এর আগ্রহ সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা ছিল মৌলিক। বিশেষ করে জর্জ হ্যারিসনসহ দ্য বিটলস গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেতারকে এক বৈশ্বিক প্রতীকে পরিণত করে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য; সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' ও 'অপরাজিত'-এর সংগীত পরিচালনা করে তিনি চলচ্চিত্রে এক নতুন সংযমী ভাষা তৈরি করেন। তাঁর বিশ্বমানবিক ভূমিকার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিউইয়র্কে আয়োজিত ঐতিহাসিক 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'

পণ্ডিত রবিশঙ্করের সংগীতজীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও আবেগঘন অধ্যায়টি জড়িয়ে আছে ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ-র সঙ্গে। বয়সে ছোট হলেও বিলায়েত খাঁ তাঁকে 'দাদা' বলে ডাকতেন, কিন্তু সে সময়ের রসিকদের একটি বড় অংশ সেতারে বিলায়েত খাঁকে কিছুটা বেশি অগ্রসর মনে করত। এই তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রবিশঙ্করের মনে একধরনের অস্বস্তি ও আত্মসংঘাতের জন্ম দেয়। ১৯৩৯ সালে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরবর্তীকালে দিল্লিতে পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সুবাদে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তবে, এক যৌথ অনুষ্ঠানের পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে বিলায়েত খাঁ নাকি তাঁকে ‘হারিয়ে দিয়েছেন’। এই প্রতিবেদন তাঁকে গভীরভাবে আহত করে, যদিও বিলায়েত খাঁ নিজেই তাঁকে শান্ত করেন এবং সংগীতকে লড়াইয়ের জায়গা না বানানোর অনুরোধ জানান। রবিশঙ্কর অকপটে স্বীকার করেছেন যে বিলায়েত খাঁ ছিলেন তাঁর 'গ্রেটেস্ট অ্যাডমায়ারার'-দের একজন এবং তাঁর বাজনায় ছিল রোমান্টিক লিরিসিজম, বয়ান্সি ও ভিগারের অনন্য সমন্বয়।

আত্মজীবনী ‘রাগ-অনুরাগ’-এ পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর জীবনের এক কঠিন সত্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন যে ১৯৪০-৪১ সালে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে মুসলমান শিল্পীদের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকায় সমাজে এমন এক ধারণা গেঁথে গিয়েছিল যে 'খাঁ' উপাধি না থাকলে শিল্পীর গায়কি বা বাজনায় জৌলুশ, গভীরতা বা গ্রহণযোগ্যতা আসে না। এই অবমূল্যায়ন তাঁকে গভীরভাবে আহত করেছিল এবং একসময় ক্ষোভ ও হতাশা থেকে তিনি নিজের নাম বদলে ‘রব্বন খাঁ’ রাখার কথা ভেবেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি সে পথে যাননি, তবু এই স্বীকারোক্তি সেই সময়ের সংগীতজগতের ধর্মগত ও পরিচয়ভিত্তিক কঠিন টানাপোড়েনকে তুলে ধরে। এই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিযোগিতা, অবমূল্যায়ন, এবং ব্যক্তিগত আঘাতের ভেতর দিয়েই তিনি নিজেকে পরিশীলিত করেছেন। রবিশঙ্করের শিল্পীজীবন দেখিয়ে দেয় যে শিল্পের পথে প্রতিদ্বন্দ্বীর মহত্ত্ব স্বীকার করা, বিরোধের মধ্যেও শ্রদ্ধা ধরে রাখা এবং নিজের যন্ত্রণাকেও শিল্পের অংশ করে নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকার।

প্রয়াণদিবসে পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, সংগীত কেবল কারিগরি দক্ষতা বা জনপ্রিয়তার বিষয় নয়, এটি এক গভীর মানবিক সাধনা যেখানে প্রতিযোগিতা থাকলেও তার ঊর্ধ্বে রয়েছে সৌন্দর্য, সত্য আর মানবিকতার এক বিস্তৃত, বহমান সুর।