ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রম্যা কৃষ্ণণ এক অনন্য নাম, যিনি তাঁর চার দশকেরও বেশি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শুধু অভিনয়ই করেননি, বরং সিনেমার গতানুগতিক ধারাকে ভেঙেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, একজন অভিনেত্রী শুধু নায়িকা হয়েই সীমাবদ্ধ নন, বরং ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরে তিনি দর্শকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়তে পারেন।
নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে
রম্যা কৃষ্ণণের অভিনয় জীবন শুরু হয় খুব অল্প বয়সে, ১৯৮৫ সালে তামিল ছবি 'ভেলাই মানসু' দিয়ে। এরপর থেকে তিনি আর পিছন ফিরে তাকাননি। নব্বইয়ের দশকে তিনি তামিল ও তেলেগু সিনেমায় নিজেকে একজন শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সময়ে তাঁর প্রাণবন্ত এবং সাহসী চরিত্রগুলো তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। তেলেগু ছবিতে 'আল্লারি মোগুদু', 'হ্যালো ব্রাদার' এবং 'নারসিমহা নাইডু'-র মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় আজও স্মরণীয়। একই সময়ে তিনি হিন্দিতেও কাজ করেছেন, যেখানে সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে 'খলনায়ক' এবং যশ চোপড়ার 'পরম্পরা' ছবিতে তাঁর সাহসী ও নজরকাড়া উপস্থিতি দর্শকদের চমকে দিয়েছিল।চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নতুন দিগন্ত
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রম্যা কৃষ্ণণ ধীরে ধীরে প্রধান নায়িকার চরিত্র থেকে আরও পরিণত ও শক্তিশালী চরিত্রে সরে আসেন। তাঁর এই পরিবর্তন ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, যা তাঁর ক্যারিয়ারকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। এই পর্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো দুটি ঐতিহাসিক চরিত্র, যা তাঁকে শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং সারা ভারতের কাছে পরিচিত করে তোলে।নীলাম্বরী, 'পদ্মায়েপ্পা' (১৯৯৯): রজনীকান্তের বিপরীতে এই ছবিতে তিনি একজন প্রতিশোধপরায়ণ এবং অহংকারী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চরিত্রে তাঁর অভিনয় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তিনি শুধু একজন পার্শ্ব-চরিত্র হয়ে থাকেননি, বরং ছবির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন। রজনীকান্তের মতো তারকার পাশে দাঁড়িয়েও তিনি নিজের অভিনয়শৈলী দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নেন, যা তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়।
শিবগামী দেবী, 'বাহুবলী' সিরিজ (২০১৫-২০১৭): এস. এস. রাজামৌলির এই মহাকাব্যিক ছবিতে শিবগামী চরিত্রে রম্যা কৃষ্ণণের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মাইলফলক। একজন দৃঢ়চেতা, ন্যায়পরায়ণ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণকারী রানীর চরিত্রে তিনি এতটাই প্রাণবন্ত অভিনয় করেন যে, এই চরিত্রটি সিনেমার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁর অভিব্যক্তি, সংলাপ বলার ভঙ্গি এবং ব্যক্তিত্বের গভীরতা শিবগামীকে শুধুমাত্র একটি চরিত্র নয়, বরং একটি আইকনে পরিণত করে। 'বাহুবলী' সিরিজ রম্যা কৃষ্ণণকে সর্বভারতীয় পরিচিতি এবং সমালোচকদের প্রশংসা এনে দেয়।
বয়স শুধু একটি সংখ্যা: বহুমুখিতা ও জনপ্রিয়তা
রম্যা কৃষ্ণণের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো একই নায়কের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে তাঁর অভিনয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো মহেশ বাবু। ২০০৪ সালের তেলেগু ছবি 'নানি'-তে তিনি মহেশ বাবুর প্রেমিকা চরিত্রে অভিনয় করেন। অথচ দুই দশক পর, ২০২৪ সালের বহুল আলোচিত ছবি 'গুন্তুর কারাম'-এ তিনি সেই মহেশ বাবুরই মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ঘটনা তাঁর বহুমুখী প্রতিভার এক দারুণ উদাহরণ।তিনি প্রমাণ করেছেন যে, অভিনয় দক্ষতা এবং চরিত্রের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে বয়স বা চরিত্রের ধরন কোনো বাধা নয়। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি টেলিভিশন নাটক এবং রিয়েলিটি শো-তেও সমানভাবে সফল হয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯৮ কোটি রুপি। নায়িকা হিসেবে দাপট দেখানোর পর এখন তিনি একজন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। রম্যা কৃষ্ণণ কেবল একজন অভিনেত্রী নন, বরং ভারতীয় সিনেমার একজন আদর্শ, যিনি প্রমাণ করেছেন যে শিল্পীর কোনো নির্দিষ্ট রূপ বা বয়স হয় না।