মহেশ বাবু—দক্ষিণ ভারতের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এক ম্যাজিক্যাল নাম। যদিও নামটা উচ্চারণে একটু জড়তা ধরতে পারে, তবু তাঁর চোখেমুখে এক অনবদ্য সৌন্দর্য, অভিনয়ে পরিশীলিত দক্ষতা এবং পর্দায় এক আলাদা উপস্থিতি রয়েছে। মহেশ বাবু শুধু তেলেগু ভাষাভাষী রাজ্যগুলোতেই নয়, বাংলাদেশসহ ভারতের বাইরের নানা দেশে তাঁর ভক্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ৯ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে এই স্টাইলিশ অভিনেতা তার ৫০তম জন্মদিন পালন করলেন। জন্মদিন উপলক্ষে চলুন দেখি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও সাফল্যের গল্প।

পারিবারিক পটভূমি থেকে শুরু
মহেশ বাবু জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট চেন্নাইয়ে। যদিও তাঁর শিকড় পশ্চিম তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে। তাঁর পরিবার থেকেই শিল্পের প্রতি ঝোঁক পেয়েছিলেন মহেশ। পিতা ঘট্টামানেনি কৃষ্ণা ছিলেন একজন বিশিষ্ট তেলেগু চলচ্চিত্র অভিনেতা, যিনি ৩৫০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বড় ভাই রমেশ বাবুও ছিলেন অভিনেতা এবং পরবর্তীতে প্রযোজক। মহেশের শৈশববন্ধুদের মধ্যেও রয়েছে দক্ষিণ ভারতের পরিচিত তারকাদের নাম, যেমন তামিল অভিনেতা বিজয় ও বলিউড অভিনেত্রী কীর্তি সুরেশ।
মহেশ বাবু মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু করেন বাবার প্রযোজিত ‘নিদ’ (১৯৭৯) ছবিতে। এরপর শিশুশিল্পী হিসেবে ৮টি ছবিতে অভিনয় করেন। শৈশব থেকেই সংলাপ মুখস্থ করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর।

নায়ক হিসেবে অভিষেক ও উত্থান
১৯৯৯ সালে ‘রাজাকুমারুডু’ ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে মহেশ বাবুর। বিপরীতে ছিলেন বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা। ছবিটি বক্স অফিসে সফলতা অর্জন করে এবং মহেশ রাতারাতি তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির হার্টথ্রব হিসেবে আবির্ভূত হন।

২০ বছরের ধারাবাহিক সাফল্য
মহেশ বাবুর ক্যারিয়ারে ৬০টিরও বেশি চলচ্চিত্র রয়েছে। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ‘মুরারি’, ‘অথাডু’, ‘পোকিরি’, ‘বিজু’, ‘ডোকাডু’, ‘সীতামা ভাকিতলো সিরিমাল্লে চেট্টু’, ‘ব্রহ্মোৎসবম’, ‘ভারসুডু’, ‘মহর্ষি’, ‘সারিলেরু নিকেভভারু’ অন্যতম। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পোকিরি’ ছবিটি পরে হিন্দিতে ‘ওয়ান্টেড’ নামে রিমেক হয়, তবে মহেশ বাবু নিজে এখনও কোনো রিমেক ছবিতে অভিনয় করেননি—যা তাঁর ক্যারিয়ারের একটি ব্যতিক্রমী দিক।

অর্জিত পুরস্কার ও স্বীকৃতি
মহেশ বাবু পেয়েছেন আটটি নন্দী অ্যাওয়ার্ড, যা তেলেগু সিনেমার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। এর পাশাপাশি পাঁচটি ফিল্মফেয়ার সাউথ অ্যাওয়ার্ড, তিনটি সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মুভি অ্যাওয়ার্ড, একটি আইফা পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।

ভক্তদের ‘প্রিন্স’
মহেশ বাবুর নাম মানেই এক আলাদা স্টাইলের প্রতীক। ঝলমলে নয়, বরং তার সৌম্য চেহারা, সংযত অভিনয় এবং শক্তিশালী স্ক্রিন প্রেজেন্স তাঁকে করে তুলেছে এক অনন্য তারকা। ভক্তরা তাঁকে ‘প্রিন্স’ এবং ‘তেলেগু ছবির রাজপুত্র’ নামে ডাকেন। ২০১০ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ‘৫০ মোস্ট ডিজায়ারেবল মেন অব ইন্ডিয়া’ তালিকায় তিনি ছিলেন ১২ নম্বরে। পরের বছরে তিনি হৃতিক রোশন, সালমান খান ও শাহরুখ খানকে পেছনে ফেলে আরও উপরের স্থানে উঠেন। ২০১৯ সালে তিনি প্রথম তেলেগু অভিনেতা হিসেবে মাদাম তুসো মিউজিয়ামে তাঁর মোমের মূর্তি পেয়ে গর্বিত হন।

ভাষার সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে
চমকপ্রদ হলেও সত্যি, যদিও মহেশ বাবুর মাতৃভাষা তেলেগু, তিনি নিজে এই ভাষায় পড়া বা লেখা জানেন না। চেন্নাইয়ের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষালাভ করায় তামিল ও ইংরেজিতেই তাঁর পারদর্শিতা গড়ে ওঠে। তবু তিনি শোনা শুনেই সংলাপ মুখস্থ করে ক্যামেরার সামনে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁর উচ্চারণে কোনও ত্রুটি ধরা পড়ে না, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর ১৮টির বেশি ছবি হিন্দিতে ডাব হয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয়, অনেক সময় হিন্দি সংস্করণের টিভি ভিউয়ারশিপ মূল ছবিকেও ছাড়িয়ে যায়।

মানবিক জীবন
অভিনেতার সফলতার পাশাপাশি মহেশ বাবু একজন দয়ালু ও দায়িত্বশীল মানুষ। শিশু স্বাস্থ্য, ক্যান্সার চিকিৎসা, গ্রামীণ শিক্ষা ও নারী অধিকারসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত। তেলেঙ্গানার দুটি স্কুল ও অন্ধ্রপ্রদেশের দুটি হাসপাতালের জন্য তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নম্রতা শিরোদকারও সমাজসেবায় সক্রিয় এবং দুজনে মিলিয়ে ‘হিল স্পিরিট ফাউন্ডেশন’ পরিচালনা করেন।

বিতর্কের আড়ালেও অবিচল
অনেক ভারতীয় তারকার মতো মহেশ বাবুর জীবনেও কিছু বিতর্ক এসেছে। সম্প্রতি তেলেঙ্গানার একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে মহেশের নামও উঠে আসে, কারণ তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত ছিলেন। অভিযোগ ছিল, তাঁর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েছেন। যদিও এখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তদন্তে তিনি সহযোগিতা করেছেন।

রাজামৌলির সঙ্গে মহা প্রজেক্ট

সব বিতর্ক পেছনে ফেলে এখন মহেশ বাবু আলোচনায় এসেছেন ভারতের অন্যতম ব্যয়বহুল ছবি ‘জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চার’ ঘরানার সিনেমার জন্য, যা পরিচালনা করছেন ‘বাহুবলী’খ্যাত এস এস রাজামৌলি। ছবিটির বাজেট ১০০০ কোটি রুপি এবং এটি দুই পর্বে মুক্তি পাবে—প্রথম পর্ব ২০২৭ সালে, দ্বিতীয় পর্ব ২০২৯ সালে। মহেশ নিজেও এটিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে ছবি তৈরির প্রস্তুতি চলছে, যেখানে তিনি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, অ্যাকশন এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।